মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৪ অপরাহ্ন
সেলিম মিয়া- ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধিঃ
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ২১শে আগস্ট একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। কলঙ্কিত নারকীয় সন্ত্রাসী হামলার ১৯তম বছর।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ইং সালের এই দিনে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদতে নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিগোষ্ঠী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে ভয়ঙ্কর নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালায়। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হিংসার দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে। আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা অল্পের জন্য এই হামলা থেকে রক্ষা পেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী নিহত হন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী।
আহত হন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক। আহত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থকদের অনেকে এখনও স্প্লিন্টারের আঘাত নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে সংগঠনের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ওই ঘৃণ্য হামলা চালায় ঘাতকচক্র। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়ি লক্ষ্য করেও চালানো হয় ছয় রাউন্ড গুলি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি আহত হন, তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেদিনটি ছিল শনিবার।
সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। বিকেল ৪টার দিকে সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশের পর সারাদেশে একযোগে বোমা হামলায় নিহতদের স্মরণে শোক মিছিলের কর্মসূচি ছিল।
বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে এবং জয় বাংলা স্লোগান মুখরিত হয় শেখ হাসিনা বিকাল ৫টার দিকে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিপ থেকে নেমে নিরাপত্তাকর্মী বেষ্টিত অবস্থায় তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাক মঞ্চে উপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে উঠে বক্তৃতা শুরু করেন।
বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ সভাপতি দেশব্যাপী অব্যাহত বোমা হামলার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ২০ মিনিটের বক্তৃতা শেষে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে এগোচ্ছিলেন মঞ্চ ট্রাক থেকে নামার সিঁড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ দিক থেকে মঞ্চকে লক্ষ্য করে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়।
ঘড়ির কাঁটায় তখন ৫টা ২২ মিনিট। গ্রেনেডটি মঞ্চের পাশে রাস্তার ওপর গ্রেনেড পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এরপর একে একে আরও ১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আতঙ্কে মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে।
গ্রেনেডের আঘাতে মঞ্চের নিচে রাস্তার ওপরে বসা বেগম আইভি রহমানসহ অসংখ্য মানুষ লুটিয়ে পড়েন। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে পেরে মঞ্চে উপস্থিত ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ও সাবের হোসেন সহ নেতারা এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাত্ক্ষণিকভাবে এক মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন।
তবে নিক্ষিপ্ত তিনটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত থেকে যায়। মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকার কারণে তার অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান।
গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে মানুষের হাত-পাসহ বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। সভামঞ্চ ট্রাকের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় রক্তাক্ত নিথর দেহ। লাশ আর রক্তে ভেসে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর পিচঢালা পথ।
নিহত-আহতদের জুতা-স্যান্ডেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ভেসে আসে শত শত মানুষের গগনবিদারী আর্তচিৎকার। বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টারত মুমূর্ষুদের কাতর-আর্তনাদসহ অবর্ণনীয় মর্মান্তিক সেই দৃশ্য আজও ভুলিবার নই।
২১শে আগস্টের রক্তাক্ত হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। গ্রেনেড হামলার পর সেদিন রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের তিল ধারণের স্থান ছিল না।
এদিকে গ্রেনেড হামলার পর ভয়, শঙ্কা ও ত্রাস গ্রাস করে ফেলে গোটা রাজধানী আতঙ্কের রাজধানী পরিনীত হয় নিস্তব্ধ হয়ে যায় রাজধানী সহ গোটা দেশএই গণহত্যার উত্তেজনা ও শোক আছড়ে পড়ে দেশ-বিদেশে।
হামলার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজে বাঁচতে ও অন্যদের বাঁচাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঠিক তখনই পুলিশ বিক্ষোভ মিছিলের ওপর বেধড়ক লাঠি-টিয়ার শেল চার্জ করে। একইসঙ্গে নষ্ট করা হয় ওই ঘটনার যাবতীয় আলামত।
এই বর্বরোচিত হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অবঃ) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, ইসাহাক মিয়া প্রমুখ।
সেদিন আরও আহত হয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ডঃ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আ. ফ. ম. বাহাউদ্দিন নাছিম, এস এম কামাল হোসেন, পংকজ দেবনাথ, সাঈদ খোকন, নজরুল ইসলাম বাবু, নাসিমা ফেরদৌসী, শাহিদা তারেক দিপ্তী, উম্মে রাজিয়া কাজল, আসমা জেরিন ঝুমু, রাশেদা আক্তার রুমা, আবুল হোসেন মোল্লা, মামুন মল্লিক, হামিদা খানম মনিসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।