৭১সংবাদ২৪.কম- ডেস্কঃ
দুর্নীতি, গণহত্যা, গুম এবং নৈশভোটের অপরাধে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের’ মাধ্যমে তাদের পতন হয়। দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তর থেকে তাদের চিহ্ন মুছে ফেলার অভিযান চলছে পুরোদমে। অথচ বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অভ্যন্তরে এখনো এই নিষিদ্ধ ঘোষিত ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পতাকা উড়ছে — আর তা উড়াতে সহায়তা করছে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরাই।

যেখানে দেশের আনাচে-কানাচে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পলাতক, সেখানে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সাবেক ছাত্রলীগ কর্মীরা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত সংগঠন ‘স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ’-এর নেতা-কর্মীরা বুক ফুলিয়ে চাকরি করছেন। এর জন্য প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং পুনর্বাসনের দায়িত্বে আছেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট টিম, যার প্রধান হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাহিদ হোসেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মো. মিরাজ হোসেন, অননুমোদিত ও অবৈধ সিবিএর সাধারণ সম্পাদক (সিন্ডিকেট প্রধানের আস্থাভাজন), এবং সভাপতি ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ (অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী)।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বিকেবি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি নীতিমালা ২০১৮-এর ১৮ ধারায় একই কর্মস্থলে তিন বছরের অধিককাল রাখার কোনো বিধান নেই। কিন্তু বর্তমানে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণকারী দপ্তরসমূহের সিংহভাগ কর্মকর্তাই ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে একই বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরাই উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাহিদ হোসেনের আশীর্বাদে বহাল তবিয়তে আছেন।

এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য হিসেবে আছেন ডিএমডি-২ খালেদুজ্জামান (ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং বারংবার দুর্নীতির অভিযোগে গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া কর্মকর্তা), কে. এম. হাবিব উন নবী, উপমহাব্যবস্থাপক, পর্ষদ সচিবালয় — ঘুষ ও দুর্নীতির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত। সৈয়দ লিয়াকত হোসেন, উপমহাব্যবস্থাপক, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগ — তিনিও ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী পাণ্ডা জাহাঙ্গীর কবির নানকের নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি জড়িত ছিলেন।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ‘জিয়া পরিষদ’ এই পরিস্থিতিতে আর নীরব থাকতে পারেনি। তারা ইতোমধ্যে মৌখিকভাবে সকল দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ-বাণিজ্য ও পদোন্নতি বাণিজ্যের বিষয়টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলীকে অবগত করেছেন এবং শক্ত হাতে তা দমন করে ব্যাংকের অভ্যন্তরে বিরাজমান অরাজকতা ও অস্থিরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে উল্টো জিয়া পরিষদের সভাপতি ও সিনিয়র সহ-সভাপতিকে হেড অফিস থেকে অন্যায়ভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করে দেয়। মজার বিষয় হলো, এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাহিদ হোসেন নিজেকে জাতীয়তাবাদী চেতনার সৈনিক হিসেবে পরিচয় দেন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকল ফায়দা নিয়েছেন। তার স্বাক্ষরিত আদেশেই জিয়া পরিষদের সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সহ-সভাপতিসহ অন্যান্য নেতাকর্মীদের অন্যায়ভাবে বদলি করা হয়। শুধু তাই নয়, তারই নির্দেশনায় জিয়া পরিষদের অন্যান্য নেতাদের নামে মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শৃঙ্খলাজনিত মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

বদলি বাণিজ্য ও রাজনৈতিক দলাদলির কারণে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা একেবারেই ভেঙে পড়েছে বলে জানিয়েছে ব্যাংকের একাধিক সূত্র। একাধিক মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থেকে শুরু করে নেতৃস্থানীয় সব কর্মকর্তাই নিয়োগ পেয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। তারা কৃষি ব্যাংকের ধরন ও কৃষিঋণ বিতরণ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আবার প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন।

তারা আরও জানান, আমরা যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে প্রশাসনকে শক্তিশালী করে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছি, কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাতে সাড়া দেননি। এ কারণে পুরো ব্যাংকেরই শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে এবং নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের চাকরি জীবনে এমন অদক্ষ ও হঠকারী এমডি আমরা দেখিনি; উনি যোগদানের পর থেকেই একের পর এক নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে।

তবে এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও কৃষি ব্যাংকের এমডি সঞ্চিয়া বিনতে আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল নম্বরে দুই দিন ধরে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি। আবার ব্যাংকে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

সচেতন কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশাসনের এমন আচরণ কি গণহত্যাকারীদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক আনুগত্যের প্রকাশ নয়? এখনো কে বা কারা দেশের সর্ববৃহৎ বিশেষায়িত ব্যাংকে এই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করছে? কোথা থেকে আসে তাদের সাহস?

একটি নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন মহল যদি নিষিদ্ধ গোষ্ঠীকে বারবার সুযোগ দেয়, তাহলে তারা আর জনগণের পক্ষে থাকেন না — তারা স্বৈরাচারের সহযোগী হয়ে ওঠেন। কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের অভ্যন্তরে এমন প্রশাসনিক ব্যবস্থা একটি লজ্জাজনক নজির, চরম প্রতারণা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের চরম অবমাননা।

রাষ্ট্র, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অব্যবস্থাপনার ফরেনসিক অডিট সম্পন্ন করে ব্যাংকটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক রাষ্ট্রের জন্য কেবল বোঝা হয়ে থাকবে, যা দেশের কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তার পথে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।