শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন
রবিন চৌধুরী রাসেল- রংপুর জেলা প্রতিনিধিঃ
সেই আদিম যুগে প্রচলন ছিল মেয়েরা সামান্য বড় হলেই বাবা-মা মনে করে মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। আদিম যুগের মানুষেরা নানান ধরনের কুসংস্কারে বিদ্যমান ছিল। তাই তারা অপ্রাপ্তবয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতেন। অপ্রাপ্তবয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পর মেয়েরা নানান ধরনের অসুখ-বিসুখের দিকে ধাবিত হয়। যেমন, বাচ্চা প্রসব করার সময় মা ও বাচ্চা দুজনেরই জীবন মৃত্যুর ঝুঁকি হতে পারে, বাচ্চা পরিপূর্ণ পুষ্টি পায় না, প্রসূতি মায়ের রক্তক্ষরণ বেশি হতে পারে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে’র কারণে মৃত্যু হতে পারে। বাবা-মা ভালো করে না জেনে না বুঝে মাত্র ১২ থেকে ১৩ বছর না পেরোতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতেন। আদিম যুগে অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে দেওয়া একটা রেওয়াজ ছিল।
বর্তমান ডিজিটাল যুগেও আদিম যুগের মত মাত্র ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েরা প্রেম করে কোর্টে এফিডেভিট ও কাজীর মাধ্যমে বিয়ে করছে। বর্তমান সমাজে ধনী ও মধ্যবিত্ত কম এবং বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে-মেয়েরা কম বয়সে পরিবারের অজান্তে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে। বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ, এসময় ছেলে-মেয়েদের হাতে স্মার্ট ফোন। এই স্মার্টফোনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানা- অজানা যে কোন বিষয়ে খুব সহজেই জানতে পারে। অথচ এখনো আদিম যুগের মতো ছেলে-মেয়েরা নিজেরাই অপ্রাপ্তবয়সে বিয়ে করছেন এবং অর্থের অভাবে নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন অপ্রাপ্তবয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন। এই বিয়ে গুলোতে সাহায্য করছেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিউনিটি পুলিশের সদস্য ও অতিরিক্ত অর্থের লোভে কাজীরা বাল্যবিবাহ পড়াচ্ছেন।
এদিকে রংপুর কোর্ট চত্বরে খবর নিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনই প্রায় অপ্রাপ্তবয়সের ছেলে-মেয়েদের দুই থেকে তিনটা করে এফিডেভিট করে বিয়ে হচ্ছে। এই বিয়েগুলো হয় বেশিরভাগ ৩,০০০/- (তিন হাজার) থেকে ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকায় মুহুরীর মাধ্যমে কোন নোটারী প্রাপ্ত উকিলের দাঁড়া কোর্ট চত্বরেই প্রতিনিয়ত। মুহুরী আর উকিল অপ্রাপ্তবয়সের ছেলে-মেয়েদের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন কাগজপত্র তৈরি করতে সাহায্য করে কোর্ট চত্বরে সামনে কিছু কম্পিউটারে অভিজ্ঞ দোকানদাররা।
অপর দিকে খবর পেয়ে ০৮-০৫-২২ তারিখে কোর্ট চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, কোর্টে বিয়ে করতে আসা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ফাহমিদা সাথী জানান, আমাদের ১৫ দিন ধরে প্রেম। এই প্রেমের কথা বাসায় জানাজানি হলে, আমার মা বাদে আমার পরিবারের সবাই রাজি হয় ১৮ বছরের আপনের সঙ্গে বিয়ে দিতে। আপন গার্মেন্টসে কাজ করে। তাই আমার মা অন্য জায়গায় অন্য ছেলের সংগে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। সেজন্য আমি রংপুরে পালিয়ে এসে আপন কে বিয়ে করতে কোর্টে এসেছি। এডভোকেট এর মাধ্যমে এফিডেভিট করার জন্য খরচের কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলে। এডভোকেট মুহুরীর মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে ৩,৫০০/- (তিন হাজার পাঁচ শত) টাকা নিয়েছে।
পরবর্তীতে এফিডেভিটে স্বাক্ষর করা এডভোকেট জামিরুল ইসলাম (জজ কোর্ট) এর সংগে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে একটা এফিডেভিট হয়েছে। মুহুরী আমার কাছে এসে কাগজ দেখিয়ে ছিল ও স্বাক্ষর করে নিয়ে গেছে। আমি ছেলে-মেয়ের বিষয়ে কিছু জানিনা। আমি শুধু কাগজে ছিল আর স্বাক্ষর করেছি। একই সঙ্গে মুহুরীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার ফোন বন্ধ দেখায়।
রংপুর এডভোকেট অ্যাসোসিয়েশন (বার) সমিতি’র সভাপতি আব্দুল মালেক জানান, এফিডেফিট শুধু ডিক্লেয়ারেশন। আইনগত সেটার কোনো ভ্যালিড নাই। কে কখন বা কোথায় কিভাবে করে সেটা আমরা জানি না। অনেকেই বাড়িতে ও রাতের মধ্যেও এফিডেভিট করে। আমাদের কোর্টে একশো’র উপরে নোটারীয়ান এডভোকেট আছে। আইনগত ভাবে এমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই যে বারের কাছে অনুমতি নিতে হবে। আইনগত আইন ইমপ্লিমেন্ট করার দায়িত্ব হল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যথাযথ কর্তৃপক্ষ। আমরা বলি এই ধরনের কাজ করি না আর আমাদের নলেজে আসলে আমরা ডিসকানেক্ট করি। সেজন্য আমরা প্রায় মিটিংয়ে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র দেখে এফিডেভিট করে দেয়। সেদিকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মালেক আরো বলেন, আপনি এখন বললেন কিন্ত সেদিন আমাকে অন্য একজন এ বিষয়ে জানাইছে। তখন আমি এডভোকেট জামিরুল ইসলাম (জজ কোর্ট) এর সঙ্গে কথা বলি। তাকে বলছি মেয়ের বয়স কম। আপনি এফিডেভিট করেছেন কেন। তখন জামিরুল বলে যে আমাকে বয়সের সার্টিফিকেট দেখাইছে। সেজন্য আমি এফিডেভিট করেছি। অপ্রাপ্ত বয়সে ছেলে-মেয়েদের এফিডেফিট আমি করিনা আর কোনদিন করবো না।
ডিজিটাল যুগেও গ্রামগঞ্জে আনুষ্ঠানিক ভাবে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়। সমাজের টাকা নাই এমন অসহায় পরিবারের মেয়েদের স্থানীয়ভাবে চাঁদা আদায় করে বিয়ের আয়োজন করা হয়। এতে সাহায্য করে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সদস্যরা।
এদিকে খবর পেয়ে ঘটনা স্থানে গেলে (১২-০৫-২২) তারিখে ১৫ নং ওয়ার্ডের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সানজিদা আক্তার জানান, আমার বাবা সামান্য মুরগির ব্যবসা করে। আমাদের সংসার তিনবেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না। আমরা তিন ভাইবোন। বাবা আমার সহ আমার ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ যোগাতে হিমশিম খায়। তাই আমার বিয়ের জন্য ভালো সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে এক বাপের এক ছেলে। অনেক জায়গা-জমিন আর নিজস্ব ব্যবসা আছে। অভাবের সংসার থেকে বাঁচার জন্য আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।
পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সানজিদা আক্তার জানান, আমি নবম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছি। আমার অনেক বান্ধবীদের আমার মত অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হয়েছে। তারা এখন পড়াশোনা করতিছে। বিয়ের পর আমিও আমার বরের সঙ্গে কথা বলে দেখব। সে আমাকে পড়াশোনা করাতে চায় কি না। জেএসসি রেজাল্ট এর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ৪.৫০ পেয়েছি।
একই সংগে সাংবাদিকদের আরো প্রশ্নের জবাবে সানজিদা আক্তার বলেন, আমার বিয়ে দিতে এলাকার লোকজন সাহায্য করছে। পাশাপাশি যে কাজী বিয়া পড়াবে। তার নাম জিজ্ঞেস করলেও বলতে পারে না। এমনকি ওর বাবা-মা কাজীর নাম বলতে চায় না।
রংপুর জেলা কাজী সমিতি’র সভাপতি আব্দুল কাদের বলেন, বাল্যবিবাহ আইনগত অপরাধ। বাল্যবিবাহ যারা দেয় অবশ্যই তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অপরাধী। আমাদের সংগঠনের সকল কাজী সদস্যদেরকে বলা আছে। কেউ কোন ভাবেই যেন বাল্যবিবাহ না দেয়। কেউ বাল্যবিবাহ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে। সত্যতা পাওয়া গেলে সংগঠন তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।