শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:০৬ অপরাহ্ন
হারুন-অর-রশিদ বাবু- বিশেষ প্রতিনিধিঃ
সমবায় হল একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যেটি একদল সদস্য তাদের সম্মিলিত কল্যাণের জন্য পরিচালনা করেন। আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী (International Co-operative Alliance) এর সংজ্ঞামতে সমবায় হল সমমনা মানুষের স্বেচ্ছাসেবামূলক একটি স্বশাসিত সংগঠন যা নিজেদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা পরিচালনা করে। সমবায় সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারী সহ সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির জন্য স্বতন্ত্র আইনী থাকলেও উত্তরের জেলা রংপুরের দৃশ্য বলছে ভিন্নকথা!
সমবায় নিয়ে দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে বদরগঞ্জ উপজেলার মাঝিপাড়া গ্রামে দারিদ্র বিমোচনের আশায়, সমবায় সমিতিতে সঞ্চয় করে এখন মূলধন হারাতে বসেছেন সপ্ততিতম বৃদ্ধা শ্রীমতি অঞ্জুবালা। যদিও তার মতো আরও শত-শত আমানতকারীর একই অবস্থা। কারন, অঞ্জুবালার চাওয়া, সঞ্চয়ের টাকা ফেরৎ পেলে একটা কিছু করার মাধ্যমে অন্ন যোগারের ব্যবস্থা করে কষ্ট লাঘব করা। অঞ্জুবালার সঞ্চয় আমানত ১ হাজার ৫৫৭ টাকা। অন্যদের কারও সঞ্চয় ও ডিপোজিট মিলে ৫০ হাজার হতে ১ লক্ষ, কারও ২, ৩, ৪ হতে ৫ লক্ষ টাকা।
মডেল মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, বসন্তপুর, বদরগঞ্জ, রংপুর-২০১১ সালে নিবন্ধন প্রাপ্ত হয়ে জেলা ব্যাপি কর্মপদ্ধতি শুরু করেন। শুরুতে সুনামের সাথে কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায়, শ্যামপুর বাজারসহ-এর আশ-পাশ এলাকা, সদর উপজেলা এলাকার মাটিয়াপাড়া বাজার, সিটি কর্পোরেশন এলাকার নজীরেরহাট ও গণেশপুর একালার বহু সংখ্যক সদস্য এই সমিতিতে সঞ্চয় জমা করেন। এক পর্যায়ে রংপুর ইউনিট-২ নামে মধ্য গনেশপুর এলাকায় একটি শাখা কার্যালয় খুলে এখানেও সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সমিতির ২০১৯ সালের অডিট রিপোর্ট দৃষ্টে জানাযায়-এর সদস্য সংখ্যা ১৪৪৯ জন। সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়োগ লাভ করেন ২০১৬ সালে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সবাই একই পরিবারের। আর কমিটির গঠন প্রক্রিয়া (সাধারণ সভা/ নির্বাচন) সম্পর্কে কোন সদস্য কিছু জানেন না বলে এই প্রতিবেদককে বলেন।
শ্যামপুর বাজার ও মাটিয়াপাড়া বাজারের একাধিক সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, বিগত করোনার সময়কাল হতে ব্যবস্থাপনা কমিটি সমিতির সদস্যদের সঞ্চয় ও ঋণ দানসহ আমানত সংগ্রহ কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে সদস্যরা আমানত সংগ্রহকারীদের সাথে নানা ভাবে যোগাযোগ করেও ঋণ বা মূলধন চেয়েও ফেরৎ পাচ্ছেন না। এ সম্পর্কে এই প্রতিবেদকসহ একাধিক সাংবাদিক বদরগঞ্জ উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোছাঃ হোসনে আরা বেগমের স্বাক্ষাৎ করে সমিতিটির হালনাগাদ তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেলা সমবায় অফিস হতে প্রায় ১ বৎসর পূর্বে এই সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আর জেলা সমবায় অফিসার মোঃ আব্দুস সবুর এই প্রতিবেদকে বলেন, উপজেলা কর্মকর্তার প্রস্তাবের ভিত্তিতে সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে, এর নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। অবসায়নে ন্যস্থ করা হয় নাই। এ ব্যাপারে মডেল মাল্টি পারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড-এর ‘আ’ আদ্যাক্ষর নামের সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাকে পূর্বাহ্নে কোনকিছু না জানিয়েই সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। আমি সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টা জেনেছি।
সমিতির নিরিক্ষকদের সায়ে ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, ক্ষমতার অপব্যাবহার ইত্যাদি নানা অব্যবস্থায় ২০১৯ সালের অডিটে সমিতিতে বড় ধরনের অনিয়ম সংগঠিত হয়ে থাকতে পারে মর্মে রিপোর্টে উল্লেখ করে সরেজমিন তদন্তের সুপারিশ করা হয়। এরপর আরও একটি অডিট সমবায় অফিসের তত্ত্বাবধানে একে-একে দু’টি অন্তবর্তী কমিটি গঠন করা হলেও, সমিতি কার্যালয়ের আশ-পাশ এলাকাতেই অসংখ্য সদস্যের দায়- দেনার বিষয়টি আড়াল করে সমিতির নিবন্ধন বাতিলের প্রস্তাব করা ও শুধুমাত্র আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েই, নিবন্ধন বাতিল করার ঘটনা। হাজারো সদস্যের আমানত ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। সদস্যদের অভিযোগ, সমিতির অনিয়ম ও নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত বিষয় সকল সদস্যের নিকট গোপন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন অনুসন্ধানে জানাযায়, রংপুর জেলা ও উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হাজারো সমবায়ীর জমাকৃত অর্থ আত্মসাৎ করছে বিভিন্ন পর্যায়ের সমবায় সমিতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমবায়ের গর্ব করার মত সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যগত ইতিহাস থাকলেও বর্তমানে, কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের দায়সারা দায়িত্ব পালনেই মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সু-দৃষ্টি পেলে ঘুরে দাড়াবার সুযোগ এখনো আছে।