রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৯ অপরাহ্ন
আরিফ শেখ- অনুসন্ধানী প্রতিবেদকঃ
নিকোটিন সমৃদ্ধ তামাকের কালো ছায়া গ্রাস করছে রংপুরের তারাগঞ্জে ফসলের অধিকাংশ ক্ষেত। তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রচার প্রচারণাসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তারাগঞ্জে দেখা মেলেনি কোন কার্যকরী উদ্যোগ। ফলে কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না তামাক চাষ। সবুজের আড়ালে পাতায় পাতায় নিকোটিন নিয়ে বেড়ে উঠছে একেকটি চারা। সাথে যোগ হয়েছে প্রণোদনার সার। স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক, চাষাবাদে মাটির গুনগত মান নষ্ট হচ্ছে জেনেও তামাক চাষ দিনের পর দিন বাড়িয়ে চলেছেন চাষিরা। এতে যেমন তামাক গিলে খাচ্ছে ফসলি জমি, কমে গেছে গম, ভুট্ট, সরিষা, সবজি, ডাল, তৈলবীজ ও ধানসহ রবি মৌসুমের বিভিন্ন ফসলের চাষ।
রংপুর জেলার মধ্যে তামাক উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে তারাগঞ্জ উপজেলা। এর অন্যতম কারন হচ্ছে, – রংপুরাঞ্চলে তামাক চাষীদের ঋণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিকল্প ফসল উৎপাদনে বীজ প্রাপ্তির জটিলতা, উৎপাদন খরচ বেশি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য ও সংরক্ষণ সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় চাষিদের দুর্বলতা বাড়ছে তামাক চাষে। এই বিষ চাষের ফলে ধান ফলনে বিঘা প্রতি ৫-৬ মণ কম হয় বলেও কৃষক সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে, তামাক চাষাবাদ এলাকায় তামাক কাটা ও শুকানোর কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে হরহামেশাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে, স্কুলগামী সড়কের দু’ধারে, বাড়ির আঙ্গিনায় তামাক শুকানোয় কোমলমতি শিশু-শিক্ষার্থীসহ স্বাস্থ্যঝুঁকি কবলে পড়েছে অধুমপায়ী সাধারণ জনতা। মাদকের আগ্রসনে যুব সমাজ ও আমাদের সবুজ শ্যামল পরিবেশ কে ধিরে ধিরে ধ্বংস করছে এই তামাক চাষ।
তামাক চাষে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ শাহীন সুলতানা জানান, তামাক চাষের ফলে মানুষ টিবি, হাঁপানী, ফুসফুসে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ ব্যাধিতে আক্রন্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তামাক রোপন, বপন ও বিক্রয় প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত শ্রমিক ও পরিবহনকারী সংশ্লিষ্ট সকলেই তামাকের ক্ষতিকর নিকোটিনের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়না।
তারাগঞ্জ উপজেলায় তামাক চাষের মহোৎসব নিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঊর্মি তাবাসসুমের সাথে কথা হলে তিনি খেই হারিয়ে ফেলেন। তামাক চাষে বর্তমানে ব্যবহৃত জমির পরিমান সম্পর্কে জানতে চাইলে চটে গিয়ে বলেন, আপনারা তো শুধু আমার দোষ খোঁজা ও ধরার জন্য পরে থাকেন। এ সময় তিনি তার অধীনস্ত অন্য কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য নিতে বলেন। কিন্তু সে তথ্য কতটুকু দাপ্তরিক নির্ভর হবে জানতে চাইলে পুনরায় ক্ষেপে যান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম আরও বলেন, আমরা কৃষক এবং চাষিদের সাথে যখন কৃষি বিষয়ক মাঠ সমাবেশগুলো করি তখন কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহী করে থাকি। তবে তামাক চাষাববাদে কৃষক ও চাষিগণ অধিক লাভ ও চাষাবাদ তামাকজাতদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অগ্রীম চাষাবাদ খরচ, বীজ, সার ও উৎপাদিত তামাক বিক্রয় নিশ্চয়তা পায়। বেশি লাভ ও বিক্রয় নিশ্চয়তা থাকলে চাষিরা তামাকই তো চাষ করবে, অন্য ফসলে তো তেমন লাভ নেই।
কৃষি অফিস কর্তৃক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় কি-না জানতে চাইলে বলেন, নিরুৎসাহী তো করি। এ ছাড়া আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে নিশ্চিত করেন।
তামাক চাষিগণ কৃষি প্রণোদনা সেবা থেকে বঞ্চিত হলে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে মর্মে জানালে তিনি বলেন, এটা আমার একার কাজ নয় এবং বলে উঠেন আপনারা (সাংবাদিক) শুধু আমাকে চাপে রাখার জন্য তথ্য চাইতে আসেন। আপনারা কোন দিন তামাক চাষবাদ রোধে কোন ভূমিকা রেখেছেন? সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন করে বসেন! তিনি আরো বলেন, আমি তো অনেক কৃষি বান্ধব কাজও করি, কই সেগুলো তো তুলে ধরেন না। জবাবে সাংবাদিক বলেন, আপনি তো আলমপুর ইউপি’র এক চাষিকে মাল্টা চাষ প্রকল্প দিয়েছিলেন, গাছ বড় হয়ে ফলন দিতে শুরু করলে চাষি দেখেন- সবগুলো গাছে গুটি গুটি কমলা ধরেছে। এতে ওই চাষীর সাথে এক প্রকার প্রতারণা হয়েছে। তিনি ভূক্তভোগীর ওই চাষীর সাথে ঘটে যাওয়া প্রতারণার বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি।
উল্লেখ্য যে, (৩১ জানুয়ারী)-২৪ইং কৃষি কর্মকর্তার সাথে হোয়াটস আপে তামাক চাষে জমির পরিমান জানতে চাইলে ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যান এবং নির্ভরযোগ্য অন্য কর্মকর্তার সহযোগীতা চাইলেও তা কর্ণপাত করেননি। উক্ত তারিখে উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা বিশ্বনাথ সরকারে সাথে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি হোয়াটস আপে তথ্য দেন । ২০২২ইং- ৭৬৫ হেক্টর, ২০২৩ইং- ৮০০ হেক্টর এবং ২০২৪ইং- ১৯৯৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। বিশ্বনাথ সরকারের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতেও তিনি গাফিলতি করেন এবং পরে (৬ মার্চ)-২৪ইং অফিস স্বাক্ষৎকারে তিনি ২০২২/২৩ইং- ৯০০ হেক্টর এবং ২০২৩/২৪ইং- ৯৬০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষের তথ্য দেন, যা দাপ্তরিক ভাবে একই অফিস থেকে প্রদেয় তথ্য অমিল ও বিভ্রান্তি বটে। এছাড়াও তিনি তামাক চাষে মাটির গুনগত মানের কি পরিমান ক্ষতি হয় সে বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারেননি। উপজেলরা মোট কৃষকের শতকরা কতজন কৃষক কৃষি প্রণোদনা সুবিধা ও চলতি অর্থ বছরে কি পরিমান বীজ, সার ও অন্যান্য সুবিধা এসেছে তার কোন তথ্য দেননি।
তারাগঞ্জ উপজেলার রহিমাপুর চাকলা কৃষক দয়াল চন্দ্র বলেন, তিনি কৃষি অফিস থেকে কৃষি প্রণোদনার কোন সুযোগ সুবিধা পান না, ফলে তিনি তামাকজাতদ্রব্য উৎপন্নকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়ে তামাক চাষ করেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অনেক তামাক চাষি কৃষি অফিসের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। যেখানে কৃষি অফিস কর্তৃক তামাক চাষিদের নিরুৎসাহীত করার কথা, সেখানে কৃষি প্রণোদনার সুবিধা প্রদান প্রশ্নবিদ্ধ! এ বিষয়ে কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাস্সুম আগামীতে এমন সুবিধা প্রদান না করার আশ্বাস দেন।
তামাক চাষ সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা বলেন, এই উপজেলায় তামাক চাষাবাদ যাতে না বাড়ে আমরা উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভাসহ অন্যান্য সকল সভায় তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহীত করার বিষয়ে আহবান করি। কৃষি প্রণোদনা ও অন্যান্য সেবা সুবিধা যাতে তামাক চাষ করে এমন চাষিদের না দেওয়া হয় সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।