শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:০৭ পূর্বাহ্ন
মুন্না শরীফ- মাদারীপুর জেলা প্রতিনিধিঃ
কাজের সন্ধানে আফ্রিকার দেশ লিবিয়া গিয়ে মাফিয়া চক্রের হাতে পড়ে লাখ লাখ টাকা হারাচ্ছেন বাংলাদেশীরা। অভিযোগ রয়েছে লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রে আছে বাংলাদেশের মাদারীপুরের দালালরাও। টাকার জন্য চলে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। দেশে থাকা পরিবারও তখন হয়ে পড়ে অসহায়। এক পর্যায়ে তাদের পরিবারের কাছে মোবাইলে ভিডিও কলে দেখানো হতো নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। পরে পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে কিছুদিনের মধ্যে মুক্তিপণের টাকা পাঠায়। এর পরেই কিছু দিনের জন্য মিলে এসব বন্দিদের মুক্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- নির্যাতন করা ওই যুবকের নাম আজিজুল হক নির্ঝর(২৮)। তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের চরনাচনা গ্রামের ১নং ওয়ার্ডের আবুল কালাম হাওলাদারের ছেলে। লিবিয়ায় পশ্চিমাঞ্চল শহর জোয়ারা ক্যাম্পের মাফিয়া শরীফ হোসেনের সহযোগী ছিলেন তিনি। তার দায়িত্ব ছিল বন্দিশালার বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করা। যারা টাকা দিতে অস্বীকার করতেন তাদের হাত মুখ বেঁধে শুরু করা হয় মির্মম নির্যাতন। প্রথমে তাদেরকে ঝোলানো হয় লোহার আড়ার সাথে। তারপর প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে ঝোলানো অবস্থায় বেদম প্রহারে মারধর করা হয়।
এসকল লোকদের নির্যাতন করার জন্য শরিফ মাফিয়া নির্ঝরকে দিতো প্রতি ঘন্টায় ৩০ হাজার টাকা। এই মুক্তিপনের টাকার জন্য নির্ঝর ছাড় দেয়নি তার একই এলাকারসহ আশেপাশের এলাকার ৭ থেকে ৮ যুবককে। তারা হলেন ছিলারচর ইউনিয়নের ল²িপুর মোড়লকান্দি ৩নং ওয়ার্ডের নুরুল হক মোড়লের ছেলে নাছিম মোড়ল, রেজাউল মোড়লের ছেলে রানা ইসলাম, মুজ্জাফার মোড়লের ছেলে শাহআলম মোড়ল, রহিম মোড়লের ছেলে শফিকুল, আমিনউদ্দীন হাওলাদরের ছেলে সরোয়ার হাওলাদারসহ বেশ কয়েকজন। শুধু নির্ঝর তার এলাকার লোকজনকে নয়। দেশের অন্যান্য জেলার লোকজনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে মুক্তিপনের জন্য।
জাহাঙ্গীর শেখ(২৮) মুন্সিগঞ্জ জেলার মোল্লাকান্দি এলাকার সেলিম শেখের ছেলে। লিবিয়ার বন্দিশালায় থাকাকালীন আজিজুল হক নির্ঝরের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়া যুবক। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে স্থানীয় দালাল আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে ২০২১ইং সালের ১৬ই নভেম্বর কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সেখানে গিয়ে মাফিয়ার হাতে পড়ে নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে কেটেছে তার জীবন। পরে টাকার বিনিময়ে লিবিয়ার বন্দিঘর থেকে মুক্ত হয়ে হাইতেম নামের এক দালালের মাধ্যমে ২০২২ সালের ৬ এপ্রিল পৌঁছেছেন ইতালিতে। দীর্ঘদিন ইতালির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ভারত-লিবিয়ায় নির্যাতনের বেদনাময় কাহিনী শোনালেন জাহাঙ্গীর।
ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর শেখ বলেন- নির্ঝর এতোটাই পাষাণ ছিল যে, ও কাউকেই ছাড়তো না। মুরুব্বী বয়সের লোকজনকেও টাকার জন্য প্রচুর মারধর করতো। গলায় পাড়া দিয়ে, দাড়ি টেনে কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন চালাত। বন্দিঘরের বিভিন্ন জায়গায় লেগে আছে রক্ত দাঁগ। আমরা হয়তো ভুল করে এ পথে এসেছি। কিন্তু নির্ঝর বাঙালি হয়েও আমাদেরকে টাকার জন্য কি অমানবিক নির্যাতন করেছে। প্রশাসনের কাছে আমরা এর বিচার চাই।
আরেক ভুক্তভোগী মোস্তফা কামাল(৩২)। কক্সবাজার চকরিয়ার বাসিন্দা। ২০১৪ইং সালে লিবিয়া যাওয়ার পর থেকে সেখানেই রঙের কাজ করতেন। তাকে কাজে বের হওয়ার সময়ে ধরে নিয়ে যায় মাফিয়া শরীফ হোসেনের লোকেরা। পরবর্তীতে একই ক্যাম্পে বসে নির্ঝর নির্যাতনের মাধ্যমে ১০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে নেয়।
মোস্তফা কামাল বলেন- অন্ধকার রুমে খাবার পানি না দিয়ে অনেক কষ্ট দেওয়া হতো। মুক্তিপণের টাকার জন্য এতোটাই মেরেছে এখনও শরীরের দাগগুলো যায়নি। আমরা নির্ঝরের বিচার চাই।
ভুক্তভোগী নাসিমের মা রুবিনা বলেন- গত এক বছর ধুরাইল ইউনিয়নের দালাল শাহআলমের সাথে ৮ লাখ টাকা চুক্তি হয় লিবিয়া দিয়ে ইতালিতে পাঠাবে। কিন্তু লিবিয়া নিয়ে দালালের কাছে বিক্রি করে দেয় আমি ছুটে আসি শাহআলমের কাছে সে বলছে আমি পৌঁছাইয়া দিবো। লিবিয়ার মাফিয়া শরিফের লোক নির্ঝর সে মারতে মারতে আমার পায়খানা ও বমি করে দিয়েছে তারপরও নির্ঝর মারা বন্ধ করেনি। নির্ঝর আমার এলাকার লোক সে কিভাবে মারলো আমি নির্ঝরের বিচার চাই।
ভুক্তভোগী সোবহান হাওলাদারের বাবা আমিনউদ্দীন হাওলাদার বলেন- টাকার জন্য যেভাবে নির্যাতন করেছে চোখে দেখলে কোন বাবা ঠিক থাকতে পারবে না। ভিডিও কল করে আমাদের চোখের সামনে মারছে নির্ঝর। আমরা নির্ঝরের সঠিক বিচার চাই।
ভুক্তভোগী রানা ইসলামের মা কোহিনূর বেগম বলেন- আমার স্বামী রিক্সা চালায় ঢাকার শহরে। ছেলেকে বিদেশের লেইগা টাকা দিয়েছি ধার দেনা কইরা দালাল শাহআলমকে। তারপরে লিবিয়া নিয়ে শাহআলম দালাল আমার ছেলেকে বেইচা ফালাইলো মাফিয়াদের কাছে। এরপরে মাফিয়া নির্ঝর টাকার জন্য আমার ছেলেকে এমন মারলো। ছেলে বলে মা আমারে মাইরা ফেলাও আর না হয় টাকা দিয়ে আমারে বাঁচাও। আমি নির্ঝরের শাস্তি চাই।
আরেক ভুক্তভোগী শফিকুলের বাবা রহিম মোড়ল বলেন- আমার ছেলেকে শাহআলম দালালের এলাকায় ট্রাক্টর চালাই তো। তাকে ফুসলায় ফাঁসলা ৮ লাখ টাকার মাধ্যমে লিবিয়া পাঠায়। তারপরে ছেলেকে শাহআলম দালাল মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। মাফিয়ারা আমার ছেলেকে এমন ভাবে নির্যাতন করছে মারতে মারতে বেহুশ হয়ে গেছে। তারপরও পিটাইছে মাফিয়া নির্ঝর। নির্ঝর আমার এলাকার ছেলে হয়ে টাকাট জন্য এমনভাবে মারছে মারার ভিডিও দেখে আমরাও বেহুশ হয়েছিলাম। নির্ঝর কিভাবে এই কাজটা করলো প্রশাসনের কাছে আমরা নির্ঝরের বিচার চাই।
মাদারীপুর সদর উপজেলার হোসনাবাদ এলাকার রাকিব ফরাজী নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, শরীফের ক্যাম্পে আমি বন্দি ছিলাম। ক্যাম্পে থাকার দুই মাসের মধ্যে নির্ঝরের নির্যাতনের শিকার হয়ে ২টি ছেলে মারা গিয়েছে। আমাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। জ্ঞান ফেরার পর আবারও মেরেছে। মারার ফলে আমার চোখের মধ্যে রক্ত জমাট বেধে গিয়েছিল। নির্ঝরের নির্যাতনের পর আমার মাথায় মাঝে মাঝে কাজ করে না। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে মাদারীপুরে নিজ বাড়িতে ফিরেছে মাফিয়া চক্রের সদস্য অভিযুক্ত আজিজুল হক নির্ঝর।
তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমি কাজ করার জন্য লিবিয়া গিয়েছিলাম। আমাকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়ারা আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপরে আমাকেসহ অনেকে মারধর করে। আমি আরবি ভাষা জানতাম আমাকে তেমন একটা মারেনি। তখন মাফিয়া শরিফ আমাকে বলল তুমি সবাইকে চুপ থাকতে বল। এরা যেন কান্নাকাটি আর চেচামেচি না করে। করতো। আমি আরবি জানতাম বলে শরীফ আমাকে সবাইকে চুপচাপ রাখতে দায়িত্ব দিয়েছিল।
সবাইকে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন- টাকা পয়সার ব্যাপারে আমি কিছু জানতাম না। আমি শুনেছি ওখানে সাড়ে ৮ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। আমি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেইনি। আমি শুধু সবাইকে চুপচাপ রাখার জন্য শাসন করছি। আমি ক্যাম্পে ভালো সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য এই দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ যদি আমার নামে অভিযোগ করে থাকে সেটা সত্য না।
এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন- আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। মানবপাচার রোধে আমরা বদ্ধপরিকর। মানুষকে আটকে রেখে জিম্মি করে টাকা পয়সা এটা অনৈতিক কাজ। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমরা আইনের মধ্যে থেকেই মানব পাচারকারীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করছি, অনেককে আমরা গ্রেফতারও করেছি। আর সকল অভিভাবকদের উদ্দেশে বলা, তারা যেন অবৈধ পথে তাদের সন্তানকে বিদেশ পাঠিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেয়।