সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:১১ অপরাহ্ন
দুলাল হোসেন- পটুয়াখালি জেলা প্রতিনিধিঃ
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কলের দুনিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে কৃষি প্রধান বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই যার সাথে রয়েছে বীর বাঙ্গালীর চিরচেনা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। গ্রামীণ ঐতিহ্যর সাথে এদেশের মানুষের রয়েছে গভীর মিতালি।
কালের বিবর্তনে গ্রামীণ ঐতিহ্যর মধ্য হারিয়ে যেতে বসেছে মানব সভ্যতার সোনালী অতীত ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের হাল চাষ তথা লাঙ্গল জোয়াল। বতর্মান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এগুলো যেন শুধুই স্মৃতি ও ইতিহাস এমনটাই সরেজমিনে দেখা গেছে পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন উপজেলায়।
অত্র জেলার বাউফল, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, দুমকি,গলাচিপা, কলাপাড়া ও আমতলিসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের হাল চাষ অনেকটা কম। নেই বললেই চলে।
এ বিষয়ে দশমিনা উপজেলার কৃষক আজাহার উদ্দিন বলেন- আমাদের বাপ-দাদারা গরু-মহিষ দিয়া আগে আল(হাল চাষ) করত এহোন আমরা ট্রাক্টর দিয়া ক্ষ্যাত চাষ করি। এহোনতো মানষে হগোল কাম মিশিন দিয়াই করে।
ধরান্দির কৃষক আবদুল লতিফ হাওলাদার জানান- আগে মানষে গরু-মহিষ দিয়া ধান মাড়াই করত আর হালুটি করতে এহোন হেই আগের মানুও নাই যে হাল চাষ করবে আমার নিজের জমি মিশিন দিয়া চওআই আর মাড়াই মিশিন দিয়া ধান লই।
অধিকাংশ কৃষকের অভিমত কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে মানব সভ্যতার সোনালী অতীত-ঐতিহ্য গ্রাম-বাংলার সেই চিরচেনা গরু-লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের দৃশ্য।
কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরীরানী তার একটি কবিতায় লিখেছেন “ভোর না হতেই লাঙ্গল কাঁধে মাঠ পানে কে ধায় সে আমাদের কৃষক উহার বাস আমাদের ঘায়”
লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ এখন শুধুই স্মৃতি।
এক সময় দেখা যেত সেই কাক ডাকা ভোরে কৃষকরা গরু ও কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে বেরিয়ে যেত মাঠের জমিতে হালচাষ করার জন্য। বর্তমানে আধুনিকতার স্পর্শে ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনে এসেছে নানা পরিবর্তন।
আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়াও লেগেছে কৃষিতে। তাই আর সকালে কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেতে আর দেখা যায় না কৃষকদের।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙল, জোয়াল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হাল চাষের পরিবর্তে এখন ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করা হয়। এক সময় হাল চাষ করার জন্য। আবার অনেকে গবাদিপশু দিয়ে হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন।
আবার অনেকে, ধান গম, ভুট্টা, তিল, সরিষা, কলাই, আলু প্রভূতি চাষের জন্য ব্যবহার করতেন। নিজের সামান্য জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করত।
হালের গরু দিয়ে দরিদ্র মানুষ জমি চাষ করে ফিরে পেত তাদের পরিবারের সচ্ছলতা। আগে দেখা যেত কাকডাকা ভোরে কৃষক গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল নিয়ে মাঠে বেড়িয়ে পড়ত। এখন আর চোখে পড়ে না সে দৃশ্য। জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চালাচ্ছে জমি চাষাবাদ। তাই কৃষকরা এখন পেশা বদলি করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু, লাঙল, জোয়াল দিয়ে জমিতে হাল চাষ।
বাউফলের কৃষক সিকদার মো. রিপন বলেন, ছোটবেলায় দেখতাম দাদায় হাল চাষের কাজ করত গরু দিয়ে। বাড়িতে হাল চাষের বলদ গরু ছিল ২-৩ জোড়া। চাষের জন্য দরকার হতো ১ জোড়া বলদ, কাঠের তৈরি লাঙল, বাঁশের তৈরী জোয়াল, মই, লরি তৈরি গরুর মুখে টোনা ইত্যাদি। আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো।
অনেক সময় গরুর গোবর জমিতে পড়ত, এতে করে জমিতে অনেক জৈবসার হতো। ক্ষেতে ফলন ভালো হতো। এখন নতুন নতুন আধুনিক বিভিন্ন মেশিন এসেছে সেই মেশিন দিয়ে এখানকার লোকজন জমি চাষাবাদ করে। তাই এখনো গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল নিয়ে জমিতে হাল চাষ করা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
গরুর লাঙল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৬৬ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে গরুর লাঙলের চাষ গভীর হয়। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশক কম লাগতো। দিনে দিনে এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। কলাপাড়ায় কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে মানব সভ্যতার সোনালী অতীত লাঙ্গল জোয়াল।