বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৫ অপরাহ্ন
হারুন-অর-রশিদ- বিশেষ প্রতিনিধিঃ
গত ৩রা মার্চ শুক্রবার সকাল ১০টায় ধুমেরকুটি ফাজিল মাদ্রাসার নবাগত অধ্যক্ষ আব্দুল আখের’র আহবানে অত্র মাদ্রাসার নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরী মিটিংয়ে চাকুরির বিনিময়ে ১৬ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত!
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলাধীন হারাগাছ ধুমেরকুটি ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগের বিষয়টি এখন সবার মুখে। তাইতো জয় বাংলা বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী রসিকতার ছলে আমাদের কণ্ঠকে বলেন, “সবার মুখে হই চই ১৬ লাখের ভাগ গেলো কই?”
ষোলো লাখের ভাগাভাগির রহস্য খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, গত ৩রা মার্চ-২৩ শুক্রবার সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে ধুমেরকুটি ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আখের আলীর আহবানে অত্র মাদ্রাসার অফিস কক্ষে এক জরুরী মিটিং এর আয়োজন করা হয়।
এতে উপস্থিত ছিলেন- মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বাদশাহ, সহঃ সভাপতি অধ্যাপক মাজেদ আলী বাবুল, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য মোখলেস সিআইডি, মাইদুল ইসলাম মুকুল, মোজাহার আলী মোজা।
কম্পিউটার শিক্ষক মোমিনুল ইসলাম, শারীরিক শিক্ষক নুর মোহাম্মদ সুদারু। আরবী শিক্ষক রেজাউল করিম, অফিস সহকারী সাইফুল ইসলামসহ উপস্থিত অন্যন্য শিক্ষকদের মাঝে আলোচনায় এই মর্মে উপনীত হয় যে, মোখলেছুর রহমান ওরফে মোখলেস জুয়ারুর ছেলে শাকিবকে সর্বমোট ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রদান করা হবে।
উক্ত বৈঠকে ঘুষের ১৬ লাখ টাকার মধ্যে অধ্যক্ষ আব্দুল আখের আলী, সভাপতি বাদশাহ সহঃ সভাপতি মাজেদ আলী বাবুল, মাইদুল ইসলাম মুকুল, মোজাহার আলী মোজ, কম্পিউটার শিক্ষক টিআর সদস্য মোমিনুল ইসলাম, টিআর সদস্য শারীরিক শিক্ষক নুর মোহাম্মদ সুদারু, আরবী শিক্ষক রেজাউল করিম, অফিস সহকারী সাইফুল ইসলামসহ স্থানীয় ছেলেদের নামেও একটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ বিভক্ত করে দেবার পরে অবশিষ্ট টাকা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করা হবে বলেও উক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
স্থানীয়রা বলেন, ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন অধ্যক্ষ এসেছে বলে আমরা আনন্দিত কিন্তু অত্র মাদ্রাসার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট! নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে গত ৩ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের আগেই স্থানীয়ভাবে সবাই জানে এই পরীক্ষায় পাশ হয়েছে সিআইডি পুলিশ মোখলেস-এর ছেলে শাকিব। মোখলেস সিআইডি তার ছেলে পরীক্ষা দেবার দুইদিন না যেতেই এলাকার অনেককেই মিষ্টি খাওয়ার টাকা বিতরণ করেছেন। এমনকি এলাকায় অনেককেই বলেছেন “টাকা হামার বেশী চাকরি হামরাই নেমো!” তাদের এহেন অতিরঞ্জিত বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে একাধিক পরীক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন, যাহা পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:
নিবেদন এই যে, আমরা বিগত
২০/০৯/২০১২ তারিখের ধুমেরকুটি ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার কাউনিয়া, রংপুর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক অফিস “সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর” পদের জন্য আবেদন করি। যার লিখিত পরীক্ষা গত ১৮/০২/২০২৩ তারিখ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত লিখিত পরীক্ষার পূর্ব হতে শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল পদ্ধতিতে শুরু থেকেই কারচুপি এবং বিধি বহির্ভূত কিছু অনিয়ম সংগঠিত হয়েছে। যা নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ
১. অত্র মাদ্রাসার কম্পিউটার শিক্ষক মমিনুর রহমান, মাদ্রাসা অধ্যক্ষের মেইল গোপনে চেক করে ডিজি প্রতিনিধির চিঠি বের করে এবং সার্ভার হতে প্রতিনিধির মোবাইল নম্বর সংগ্রহ পরবর্তী তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র জেনে নেন। পরে সেই প্রশ্ন তারই আপন ভাগিনা সাকিব আহমেদকে সরবরাহ করেন।
২. ডিজি প্রতিনিধি নিজেই সম্পূর্ণ প্রশ্ন তৈরী করেছেন এবং নিয়োগ পরীক্ষা বোর্ডের সদস্যদের কাউকে কোন প্রশ্ন বা মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়নি! যা বিধি বহির্ভূত।
৩. ডিজিটাল পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষার খাতা তৈরী করা হয়নি এবং পরীক্ষা শুরুর আগ মুহূর্তে হাতে লেখা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া হয়। যা পরীক্ষার কার্যক্রমে অনীহা প্রকাশ পায়। মৌখিক ও ব্যবহারিক নম্বর নিয়োগ বোর্ডের ব্যবহারিক প্রতিনিধি সদস্যকে সুযোগ না দিয়ে ডিজি প্রতিনিধি নিজেই সব নম্বর বণ্টন করেছেন।
৪.নিয়োগ পরীক্ষার ৪/৫ দিন পূর্ব থেকে কম্পিউটার শিক্ষক মমিনুর রহমান তার ভাগিনা সাকিবের চাকুরী কনফার্ম হবে মর্মে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে অন্যন্য পরীক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্থানীয়দের বলেন, আমাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। যাহা নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের পূর্বাভাস! যার ফলে অনেক মেধাবী পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন।
৫. পরীক্ষার্থী নাজির হোসেন-এর ব্যবহারিক পরীক্ষায় ফাঁকা সীটে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষার কোন নীতিমালায় পড়ে আমাদের বোধগম্য নয়!
৬. উক্ত মাদ্রাসার নিয়োগ পরীক্ষায় অব্যহৃত কম্পিউটার থাকা স্বত্বেও সাকিবের পরীক্ষা তার মামা মমিনুর রহমানের ব্যবহৃত কম্পিউটারে নেয়া হয়েছে! যা সুস্পষ্ট নিয়োগ পরীক্ষার বিধি বহির্ভূত।
৭. উক্ত নিয়োগ পরীক্ষা শেষে ফল প্রকাশ না করেই চলে যান ডিজির প্রতিনিধিসহ অন্যন্যরা। পরীক্ষার ফলাফল পরবর্তীতে জানানো হবে বলে উপস্থিত সকল পরীক্ষার্থীদের চলে যেতে বলা হয়। এখন পর্যন্ত আমরা ফলাফল না জানলেও ধুমেরকুটি এলাকার হাজার মানুষ জানে চাকুরী হয়েছে মোখলেস সিআইডির ছেলে সাকিবের! উল্লেখিত অভিযোগ ধুমেরকুটি এলাকার সবাই জানে নিরপেক্ষভাবে সঠিক তদন্ত করলে দুর্নীতির চিত্র শতভাগ প্রমাণিত হবে।
ধুমেরকুটি ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি মাহবুবুর রহমান বাদশাহ বরাবর অভিযোগ দেবার পরে, জরুরী মিটিংয়ের মাধ্যমে ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে মোখলেস সিআইডি ছেলে শাকিবকে অত্র মাদ্রাসার অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আল্লাহর নবীর ঘর বলা হয় মাদ্রাসাকে। এই এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতা মাদ্রাসাকে বরাবর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বাক্ষী ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ধুমেরকুটি ফাজিল মাদ্রাসায় এই প্রথম মিটিং করে ঘুষ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্থানীয়রা আরও বলেন, এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ একজন আলেম, হারাগাছের বৃহৎ মসজিদগুলোর একটি সারাই কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব।
ওনার ঈমামতিতে হাজারো মানুষ নামাজ আদায় করেন অথচ তার নেতৃত্বেই ঘুষের মিটিং। বিষয়টা এমন যেন দূর্নীতির মাধ্যমে চাকুরীর বৈধতা দেবার টেন্ডার নিয়েছেন বর্তমান অধ্যক্ষ আখের আলী এবং ম্যানেজিং কমিটির লোকজন।
স্থানীয়রা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন- তাদের নাটক বন্ধ ও ভুয়া পরীক্ষা বাতিল করত পূনরায় নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।
উপরোক্ত সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার সভাপতি মাহাবুবার রহমান বাদশাহ বলেন, আমার খুব চেষ্টা ছিলো স্বচ্ছ পদ্ধতির মাধ্যমে নিয়োগটা হোক। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি, পরবর্তী পর্বে থাকছে বিস্তারিত। ভিতরকুটি এলাকার একাধিক বাসিন্দা সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে আমাদের কণ্ঠকে জানান। এলাকার সবাই জানে মোখলেস সিআইডি একজন পাক্কা জুয়ারু, ইতিপূর্বে ভিতরকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগকে কেন্দ্র করে তারই অনৈতিক ইন্ধনে স্থানীয় নুর বকস কবিরাজ পরিবারের, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত হয়েছে।
অনেকেই এখন তাকে এলাকার ভাইরাস সিআইডি নামেও চিনে! তার বাড়ির মোড় বা ভিতরকুটি স্কুল মোড় জুড়ে নবগঠিত একটি বাজারে তার ওঠাবসার কারণে চুকলির বাজার হিসেবে বেশ পরিচিতি আর্জন করেছে। যদিও রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় “চুকলি” বলতে সাধারণত নারীদের মাঝে কথা চালাচালিকে বোঝায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সারাই বাজারের এক পান দোকানী সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বলেন- উনিতো আমাদের সমাজের ঈমাম, নেতা। উনি সারাই বাজার জামে মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ান। এই সমাজের পক্ষ থেকে আপনাদের মাধ্যমে তার কাছে এই নিয়োগ বাণিজ্যের সত্যতা সম্বন্ধে আগামী জুম্মার খুৎবার আলোচনায় ব্যাখ্যা করার অনুরোধ করছি।