Saturday, April 20, 2024
Homeকৃষি ও অর্থনীতিনড়াইলে পতিত জমিতে লেবু চাষে অভাবনীয় সাফল্য

নড়াইলে পতিত জমিতে লেবু চাষে অভাবনীয় সাফল্য

উজ্জ্বল রায়- নড়াইল জেলা প্রতিনিধিঃ
নড়াইলে পতিত জমিতে লেবু চাষঅ ভাবনীয় সাফল্য। নড়াইল সদর উপজেলার পানতিতা গ্রামের সুজন কুমার বর্মন লেবু চাষের উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে। ঢাকায় ব্যবসা করার সময় হঠাৎ মাথায় এল পতিত জমিতে এমন কিছু চাষ করা যায় কি না, যা দিয়ে লাভের পাশাপাশি এলাকার সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। পরে চলে গেলেন নাটোর বালিয়াডাঙ্গার রুহুল আমিনের কাছে। তার পরামর্শে ড্রাগন চারা আনার জন্য টাকা দিয়ে আসেন। কিন্তু ড্রাগন চাষে সব সময় পরিচর্যা করতে হয় বলে সিদ্ধান্ত পাল্টে লেবু চাষ শুরু করেন।

এক একর (১০০ শতাংশ) জমিতে চায়না থ্রি ও সিডলেস এলাচি জাতের ৬০০ কলম চারা গাছ প্রতিটি ৫০ টাকা দরে এনে রোপণ করলেন। আর তখনই এলাকার লোকজন বিরূপ মন্তব্য শুরু করল। রাগ করে ফলন আসার আগেই সিদ্ধান্ত নিলেন গাছগুলো কেটে ফেলবেন। পরে পরিবারের পরামর্শে তা আর করেননি।
এদিকে বছর ঘুরতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল সুজনের। থোকায় থোকায় ৮ থেকে ১০টি করে লেবুর ফলন আসা শুরু হয়। পরে প্রতিটি গাছেই লেবুর ফলন আসে। বছরে প্রতিটি গাছে ১০০০ থেকে ১৫০০ লেবু ধরে থাকে।

লাভ-লোকসানের বিষয়ে সুজন বলেন, পরিপক্ব হলে প্রতিটি লেবু ৩ থেকে ৪ টাকা দরে পাইকাররা জমি থেকেই কিনে নেন। সময়ভেদে প্রতিটি লেবু ৩ থেকে ১০ টাকা দরেও বিক্রি করি পাইকারদের কাছে। প্রতি সপ্তাহে নড়াইল সদর হাটে দুবার ও তুলারামপুর হাটে দুবার আমি লেবু বিক্রয় করি। দুই হাটে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৮ হাজার লেবু বিক্রয় হয়। সে হিসাবে মাসে ৩২ হাজার লেবু বিক্রি হয়। ৩ টাকা করে ধরলে ৯৬ হাজার টাকার লেবু বিক্রয় হয়। খরচ বাদ দিলে মাসে আয় ৭০ হাজার টাকা।

লেবু-বাগানের বাড়তি কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না। সার-ওষুধেরও ঝামেলা নাই। বিক্রি করতেও বেশি ঝামেলা হয় না। বাগান থেকেই নিয়া যায়। মাঝে মাঝে আগাছাগুলো পরিষ্কার করলেই হয়। ১২ মাসই লেবুর ফলন পাওয়া যায়। স্থানীয় পাইকারদের পাশাপাশি ঢাকা থেকে পাইকাররা এসে নিয়া যায়। লেবু বিক্রয়ের পাশাপাশি প্রতিটি গাছ থেকে ২০টা করে কলম চারা গাছ বিক্রয় সম্ভব। প্রতিটি চারা গাছ ৮০ টাকা করে বিক্রয় হয়। যা একসঙ্গে বড় অঙ্কের টাকা। এটা অত্যন্ত লাভজনক।

বেকার যুবকদের চাকরির পেছনে না ঘুরে পতিত এক একর জমিতে লেবু চাষের পরামর্শ দিয়েছেন সুজন। তিনি বলেন, সব ধরনের খরচ ছাড়া আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। লেবু চাষের যে খরচ, তা এক বছরেই উঠে আসে। লেবু চাষ করে এমন অভাবনীয় সাফল্য পাওয়ায় সুজন কুমার বর্মন আরও জমিতে বড় পরিসরে চাষের চেষ্টা করছেন।

পাইকারি বিক্রেতা অজিত বিশ্বাস বলেন- প্রতিদিন আমি ৩০০ থেকে ৪০০ লেবু বিক্রি করি। এই লেবু শরবত ও ভাতের জন্য ব্যাপক চাহিদা। সুজন দাদার লেবু বাগান থেকে আমি সপ্তাহে দুই থেকে তিন হাজার লেবু কিনে নিয়া যাই। লেবুর চাহিদা বেশি হওয়ায় আমরাও লেবু বিক্রি করে বেশ লাভ পাই। লেবু বাগান করে দাদা বেশ সফল আমি ও তাই ভাবছি নিজে লেবু চাষ করব।

উদ্যোক্তা সজুনের বাগানে কাজ করে উৎস বর্মন। সে বলে, আমি স্কুলে পড়ি। পড়াশোনার ফাঁকে লেবু-বাগানে কাজ করি। এখান থেকে কাজ করে যে টাকা পাই, তা দিয়া হাতখরচ ও পড়াশোনার খরচ হয়ে যায়। আগাছা পরিষ্কার করা ও লেবু তোলা তেমন কষ্ট না হওয়ায় আমার বন্ধুরা ও আমার সাথে এখানে কাজ করে।
প্রতিবেশী সুন্দরী বিশ্বাস বলেন, আমাগে বাড়ির পাশের জমিতে যখন লেবুগাছ লাগায়, ভাবছিলাম খামোখা লেবুগাছ লাগাচ্ছে। কত কথা কইছি। এহন দেহি লেবু সারা বছর ধরে। প্রতি সপ্তায় লোকজন এসে বস্তা ভইরে লেবু কিনে নিয়ে যায়। আমাগে লেবু কিনে খাওয়া লাগে না। আশপাশের সবাই লেবু বাগানের লেবু ফ্রি খায়। এহন দেখতেছি লেবু বাগান করা অনেক লাভ। আমাগে যদি জমি থাকত, আমরাও লেবু বাগান করতাম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়- এই দুই জাতের গাছে বারো মাসই ফল ধরে। সার-ওষুধ তেমন প্রয়োজন না হওয়ায় এটি অত্যন্ত লাভজনক। নড়াইল জেলায় ২৭ হেক্টর জমিতে লেবুর আবাদ হচ্ছে। নড়াইল সদর উপজেলায় ১৫ হেক্টর জমিতে লেবুর আবাদ হয়। কৃষকের সঙ্গে পাইকারি বিক্রেতাদের সরাসরি বেচাকেনা হওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের সুযোগ না থাকায় কৃষক লাভবান হচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের কৃষিজমি পরিদর্শন করে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে আসছে। নড়াইলে লেবু জাতীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে নড়াইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। এই কৃষি কর্মকর্তা আশা করেন নড়াইলে লেবু-জাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়বে।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ রোকনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন- ভিটামিন ‘সি-এর অন্যতম উৎস হিসেবে সবার পরিচিত লেবু জাতীয় ফসলের চাষ নড়াইলে দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। কারণ খুব অল্প খরচে, অল্প পরিশ্রমে, অল্প জমিতে কৃষক লেবু জাতীয় ফসল চাষ করে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। নড়াইল সদর উপজেলার পানতিতা গ্রামের সফল উদ্যোক্তা সুজন কুমার বর্মনের চায়না থ্রি ও সিডলেস এলাচি (কাগজি লেবু) লেবু চাষের সাফল্যে এলাকার কৃষক লেবু চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন- লেবু চাষ করে যেমন কৃষক মাঠে ফসল উৎপাদন করছেন, তেমনি খেতের আলফসল হিসেবে লেবু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গাছগুলো যেমন বেড়া হিসেবে কাজ করছে, পাশাপাশি লেবুগুলো বাজারে বিক্রি করে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments